Friday, 15 June 2012

পিঙ্কি প্রামাণিক

pinki pramanik



ধর্ষণে অভিযুক্ত ‘সোনার মেয়ে’ কি পুরুষ
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা
দোহা এশিয়াডে মেয়েদের রিলেতে সোনা জিতেছিলেন যে অ্যাথলিট, সেই পিঙ্কি প্রামাণিক আদতে পুরুষ কি না, তা নিয়ে দেশ এখন তোলপাড়। বুধবার ধর্ষণ-প্রতারণা-মারধরের অভিযোগে ওই প্রাক্তন অ্যাথলিটকে পুলিশ আটক করার পরে এ প্রশ্নও উঠেছিল, পিঙ্কি কি সমকামী? নাকি তাঁর শরীরে পুরুষের সমস্ত অঙ্গ বর্তমান? বৃহস্পতিবার রাতে পিঙ্কিকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের একাংশের দাবি, ‘পুরুষ’ হিসেবেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদিও অন্য একটি অংশ বলছে, সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষার পরেই যাবতীয় ধোঁয়াশা কাটবে।
মেয়ে অ্যাথলিটদের বিরুদ্ধে ‘পুরুষ’ হওয়ার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। শাস্তিও পেয়েছেন কেউ কেউ। কিছু দিন আগে তামিলনাড়ুর শান্তি সুধারানির লিঙ্গ-পরীক্ষার পরে তাঁর পদক কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কেরলের মহিলা অ্যাথলিট নানি রাধা লিঙ্গ পরিবর্তন করে ‘রাধাকৃষ্ণ’ হয়ে গিয়েছেন। সাম্প্রতিক অতীতে মহিলা ফুটবলার বন্দনা পালকেও বাংলা দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল শরীরে ‘পুরুষালি’ ভাব প্রকট হওয়ায়। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিবিধ পদকজয়ী এক মহিলা অ্যাথলিটের বিরুদ্ধে ‘ধর্ষণের’ অভিযোগ নজিরবিহীন। আরও চমকপ্রদ, পদকজয়ী ‘সোনার মেয়ের’ বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ যিনি এনেছেন, তিনি এক জন মহিলা!
পিঙ্কি প্রামাণিক। ছবি: সুদীপ ঘোষ
পুলিশের উদ্যোগে বাগুইআটির এক বেসরকারি নার্সিংহোমে পরীক্ষার পরে ডাক্তারেরা পিঙ্কিকে ‘পুরুষ’ বলে রায় দেন। রিপোর্টে লিঙ্গ নির্ধারণের জায়গায় লেখা হয়েছে ‘মেল’। নার্সিংহোমের প্রশাসনিক অফিসার সুব্রত মুখোপাধ্যায় পরিষ্কার জানিয়েছেন, “এক জন পুরুষের যে যে অঙ্গ থাকা দরকার, পিঙ্কির শরীরে সবগুলোই দেখতে পেয়েছেন ডাক্তারেরা।”
পিঙ্কির পরিবার অবশ্য সে দাবি পুরোপুরি অস্বীকার করছে। পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডির ঝাড়খণ্ড-ঘেঁষা গ্রাম তিলকডিহিতে পিঙ্কির আদি বাড়ি। বৃহস্পতিবার সেখানে তাঁর মা পুষ্প প্রামাণিক বলেন, “পুলিশ যে অভিযোগে ওকে আটক করেছে, তাতে আমরা অবাক। আমি জানব না, ও মেয়ে না ছেলে! আমি নিশ্চিত, ও মেয়ে।” বাবা দুর্গাচরণ প্রামাণিকের মন্তব্য, “ওকে স্রেফ ফাঁসানো হয়েছে। যে অভিযোগ করেছে, তার স্বামীর কাছে পিঙ্কি টাকা পেত। তা চাইতেই ঝামেলা।”
বুধবার রাতে বাগুইআটি থানায় পিঙ্কির বিরুদ্ধে পরিচয় গোপন, ধর্ষণ, ভীতি প্রদর্শন ও মারধরের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন তাঁর পড়শি এক বিবাহবিচ্ছিন্না, যিনি গত দু’বছর পিঙ্কির বাগুইআটির বিদিশাপল্লির বাড়িতে একই সঙ্গে থাকতেন। অভিযোগকারিণী সেই অনামিকা আচার্য পুলিশকে জানিয়েছেন, পিঙ্কি আসলে পুরুষ। এবং ‘পুরুষ’ পিঙ্কি তাঁকে নিয়মিত যৌন নিগ্রহ করতেন বলে অনামিকাদেবীর অভিযোগ। থানায় বসে তিনি বলেন, “ও আমাকে প্রচণ্ড মারধরও করত। শাসাত, এ সব কাউকে বললে ক্ষতি করে দেবে। সহ্য করতে না-পেরে থানায় আসতে বাধ্য হয়েছি।”
অভিযোগ পেয়ে পুলিশ বুধবার রাতেই পিঙ্কিকে থানায় এনে জেরা শুরু করেছিল। পিঙ্কি অসুস্থ বোধ করলে তাঁকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়। নার্সিংহোমের ডাক্তারেরা তাঁকে পরীক্ষা করে ওই নাটকীয় রায় দেন।
এ দিন সকালে পিঙ্কি ও অনামিকাদেবীকে দফায় দফায় জেরা করেন পুলিশকর্তারা। দুপুরে পিঙ্কিকে বারাসত আদালতে তোলা হয়। ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় বারাসত হাসপাতালে। কিন্তু পিঙ্কি পরীক্ষা দিতে অস্বীকার করেন। প্রাক্তন অ্যাথলিট বলেন, “অতীতে টুর্নামেন্টে বহু বার ডাক্তারি পরীক্ষা দিয়েছি। আবার কেন?” পিঙ্কির দাবি, “অনামিকা আমার কাছে টাকা চেয়েছিল। দিতে রাজি হইনি বলে ফাঁসানো হল।”
বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, “বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই পিঙ্কিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগও আছে। তবে সরকারি হাসপাতালের রিপোর্ট জরুরি। আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার।” বস্তুত পিঙ্কি পুরুষ না মহিলা, তা নিয়ে পুলিশেরও বিস্তর ধন্দ। কমিশনার রাজীব কুমারের কথায়, “আগে আমাদের জানতে হবে, উনি পুরুষ কি না। না-হলে তদন্ত এগোবে কী করে?” যদিও পুলিশেরই উচ্চপদস্থ অফিসারদের একাংশের দাবি, অভিযোগকারিণীর গোপন জবাবনবন্দি, প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ এবং ওই বেসরকারি নার্সিংহোমের ডাক্তারি রিপোর্টের ভিত্তিতে পিঙ্কিকে ‘পুরুষ’ হিসেবেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
পিঙ্কিকে নিয়ে ঝামেলা অবশ্য নতুন নয়। তাঁর বিরুদ্ধে নানা সময়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় শিবিরে হরেক গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়েছেন বারবার। মারামারি করেছেন সতীর্থদের সঙ্গে। এমনকী, রিভলভার সমেত ধরাও পড়েছেন এক বার। অভিযোগ, ইস্টার্ন রেলের কর্মী পিঙ্কি পুরুষের মতোই গা-জোয়ারি আচরণ করতেন। নানা রকম নেশাও বাদ দিতেন না। সতীর্থ মেয়ে অ্যাথলিটরা পিঙ্কির সঙ্গে এক ঘরে থাকতে চাইতেন না। তেমন একাধিক জন এ দিন ইঙ্গিত দিয়েছেন, পিঙ্কি আসলে সমকামী। ‘‘এক ঘরে থাকলে ও নানা ভাবে জ্বালাতন করত।” বলেন পিঙ্কির সমসাময়িক এক মহিলা অ্যাথলিট।
পিঙ্কি সমকামী না পুরুষ, তা নিয়ে চূড়ান্ত রায় দিতে পারেন একমাত্র ডাক্তারেরা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, রেলের চাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যেখানে লিঙ্গ-পরীক্ষা বাধ্যতামূলক, সেখানে ‘পুরুষ’ পিঙ্কি বারবার উতরে গেলেন কী ভাবে?
সেই ধোঁয়াশা কাটাতেই পুলিশ এখন মরিয়া।

সাফল্য-তালিকা
২০০৫ এশিয়ান ইন্ডোর গেমস পাটায়া সোনা
২০০৬ এশিয়ান গেমস দোহা সোনা
২০০৬ সাউথ এশিয়ান গেমস কলম্বো ৩টি সোনা
২০০৬ কমনওয়েলথ গেমস মেলবোর্ন রুপো
* এ ছাড়াও রাজ্য ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচুর পদক

অবসর নিতে বাধ্য হয়েছিলেন পিঙ্কি 

রীরে পুরুষালি ভাব প্রকট হওয়ার পরই ২০০৮ সালে ‘চোট দেখিয়ে’ অবসর নিতে বাধ্য হয়েছিলেন পিঙ্কি প্রামানিক! বৃহস্পতিবার বাংলা ও ভারতের নামী এই মেয়ে অ্যাথলিটকে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ আটক করার পর এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। বাংলার অ্যাথলেটিক্স কর্তারা স্বীকার করে নিয়েছেন, ফেডারেশন চেন্নাইতে ওঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পরই বাংলা দল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় পুরুলিয়ার এই অ্যাথলিটকে। এবং শুধু তাই নয়, বাংলার লজ্জা ঢাকার জন্য গোটা ঘটনাই চেপে গিয়েছিলেন কর্তারা। প্রচার করে দেওয়া হয়েছিল, চোটের কারণেই পিঙ্কিকে অবসর নিতে হয়েছে। রাজ্য অ্যাথলেটিক্স সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট আশিস সেনগুপ্ত বললেন, “এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। চেন্নাইতে আন্তঃ রাজ্য মিটে মেয়েদের ৮০০ মিটারে পদক পাওয়ার সুযোগ ছিল ওর। কিন্তু ফেডারেশন কর্তারা আমাদের ম্যানেজারকে এসে বলেন পিঙ্কির বিরুদ্ধে হরমোন সংক্রান্ত অভিযোগ উঠছে। ঝুঁকি নিইনি।”
দশ বছর আগে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজ্য মিটে এসে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন পিঙ্কি। খালি পায়ে নেমে পেয়েছিলেন অনেকগুলি পদক। তারপর তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রাজ্য ও জাতীয় স্তরে তো বটেই এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমসেও পদক জিতেছেন আনায়াসেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, দেশে ছাড় পেলেও এশিয়াড-কমনওয়েলথে পিঙ্কি ছাড় পেলেন কী ভাবে? উত্তর হল, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির নতুন নিয়মের জন্যই। আগে লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য ‘র‌্যান্ডম’ টেস্ট হত। মহিলা সংগঠনগুলির চাপে এখন তা বদলেছে। নতুন নিয়মে অভিযোগ উঠলেই শুধু পরীক্ষা হয়। পিঙ্কি সেই সুযোগটা পেয়ে গিয়েছেন। জানা গিয়েছে, পিঙ্কিকে নিয়ে বিতর্ক হওয়ায় ২০০৩-০৪ সালে তাঁর প্রথম পরীক্ষা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাইয়ের ডাক্তাররা। তাঁরা তাকে ‘মেয়ে’ বলেই স্বীকৃতি দেন। কোনও প্রশ্নই তোলেননি। এরপর রেলের চাকরির সময়ও নিয়মানুযায়ী মেডিক্যাল পরীক্ষা হয়েছিল পিঙ্কির। সেখানেও পাস করে যান তিনি। এ দিনের ঘটনার পর রেলের উচ্চপদস্থ কর্তারা অবশ্য নতুন করে নিয়োগের সময়ের কাগজপত্র চেয়ে পাঠিয়েছেন। সর্বভারতীয় অ্যাথলেটিক্স সংস্থার কর্তা আইনজীবী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “অনেক মেয়েই আছে যাদের মধ্যে পুরুষালী ভাব থাকে। পিঙ্কিরও ছিল। ওর শরীরে পুরুষ হরমোন বেশি ছিল বলে শুনেছি।” সল্টলেক সাইয়ের অ্যাথলেটিক্সের প্রধান কোচ কুন্তল রায় বললেন, “ও আমার কাছে কোচিং নিতে এসেছিল শুরুর দিকে। আমার ওর হাবভাব দেখে সন্দেহ হয়। তাই নিইনি।”
বোহেমিয়ান জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া পিঙ্কি ইদানিং নানা ঝামেলায় জড়িয়েছেন। বারবার মোবাইলের সিম বদলাতেন। নিয়মিত নেশাও করতেন বলে অভিযোগ করেছেন তাঁর প্রতিবেশিরা। অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাক থেকে সরিয়ে নেন নিজেকে।

No comments:

Post a Comment